১০ কোটি ইউটিউব ভিউ’র রেশ ১০ মিনিটও থাকেনা !

যদি একটা গান ১০ কোটি, ১০০ কোটি কিংবা গোটা পৃথিবীর ৬০০ কোটি লোকও শোনে বা দেখে, তাহলেও কোনো লাভ নেই ! ১০ কোটি ইউটিউব ভিউ’র রেশ ১০ মিনিটও থাকেনা !

যে গানটি এক কোটি বা দশ কোটি ভিউ হয়েছে, সেই গান তো সবার মুখে মুখে থাকার কথা !

‘ভিউ বাড়াতে অনেকে স্ট্যান্টবাজি করে’

আলাউদ্দীন আলী, আলম খান, রুনা লায়লা, বাপ্পা মজুমদার, ধ্রুব গুহআলাউদ্দীন আলী, আলম খান, রুনা লায়লা, বাপ্পা মজুমদার, ধ্রুব গুহক্যাসেট বা সিডি বিক্রির হিসাবে একটা সময় শিল্পীর জনপ্রিয়তা বিচার করতেন অনেকে। যত বেশি বিক্রি, তত বেশি টিআরপি। প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের শিল্পীকে মনে করত ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’। ঘুরে যেত শিল্পীর ভাগ্য। দিন বদলেছে। এখন শিল্পীর যোগ্যতার মানদণ্ড বিচার হচ্ছে ইউটিউবে তাঁর গানের ভিউ লাখ না কোটি। আসলেই কি এটা হতে পারে যোগ্যতার মাপকাঠি? 

গায়ক ও সংগীত পরিচালক বাপ্পা মজুমদার এমনটা মানতে নারাজ। এটা স্রেফ আত্মহত্যা, বলছেন তিনি। আলাউদ্দীন আলী মনে করেন, গান শোনার জিনিস, দেখার নয়। রুনা লায়লার মতে, এখনকার ছেলেমেয়েরা জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের গান শুনছে—এটা একটা বড় ব্যাপার। ভিউ কোনো বিষয় হতে পারে না। সংগীত পরিচালক আলম খানের মতে, গানের ক্ষেত্রে অডিওটাই আসল। ভিউ কখনো মানদণ্ড হতে পারে না।

বাপ্পা মজুমদারবাপ্পা মজুমদারবাপ্পা মজুমদার বলেন, ‘ইউটিউবে গানের ভিউ দিয়ে হয়তো জনপ্রিয়তা মূল্যায়ন করা যায়, কিন্তু সেই ভিউও কতখানি জাস্টিফাইড, সেটার সত্যতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। নিঃসন্দেহে কোনো গানের ১০ কোটি, ৫ কোটি কিংবা এক কোটি ভিউ—এত মানুষ একটি গান শোনে বা দেখে—এটা বিশাল ব্যাপার। বর্তমান বাজারে এক কোটি মানুষ একটি গান শুনছে বা দেখছে—এটা কিন্তু ফেলে দেওয়ার বিষয় নয়। কিন্তু সে অনুযায়ী ফিডব্যাক পাচ্ছি কি? যে গানটি এক কোটি বা দশ কোটি ভিউ হয়েছে, সেই গান তো সবার মুখে মুখে থাকার কথা।’

বাপ্পা বলেন, ভিউ দিয়ে বিচারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আগামী প্রজন্মের সংগীত। গান তৈরির আগেই তাদের মাথায় একটি বিষয় ঢুকবে, ভিউ কত হবে। এটাকে অনেকটা এভাবেও বলতে পারি, ‘হারপিক খাও, তোমার জ্বর বা অসুখ ভালো হয়ে যাবে।’

আলাউদ্দীন আলীআলাউদ্দীন আলীইউটিউবের ভিউ একজন শিল্পীর যোগ্যতার মানদণ্ড, এই তত্ত্বে মোটেও বিশ্বাসী নন সংগীত পরিচালক আলাউদ্দীন আলী। ‘কিছুদিন আগে একজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তিনি আমাকে জানালেন, বুস্ট করে একটা গান কীভাবে ভাইরাল করানো হয়’—বললেন আলাউদ্দীন আলী। ‘তবে কিছু গান এমনিতেই হয়ে যায়। অনেককে দেখি, অখাদ্য একটা গান দেখে বা শুনে খুব মজা পেতে। আমি নাম মনে করতে পারছি না, একজন লোক রবীন্দ্রসংগীত এত জঘন্যভাবে গাইল, সেটা ভাইরাল হয়ে গেছে। ও যা-ই গায়, লোকে শেয়ার দেয়।’

গান তো দেখার জিনিস না, এটা শোনার। কতজন লোক গানটা শুনল, এরপর দু-চার লাইন মুখস্থ গাইতে পারল কি না, সেটাই দেখার বিষয় বলে মনে করেন আলাউদ্দীন আলী। তিনি বলেন, ‘দশ কোটি লোক একটা গান শুনল বা দেখল, সেটা গুরুত্বের চেয়ে যদি দশজন লোক শুনে মনে করে যে গানটা গাইতে পারে—তাহলে সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটা না হয়ে যদি একটা গান ১০ কোটি, ৫০০ কোটি কিংবা গোটা পৃথিবীর লোকও শোনে বা দেখে, তাহলে কোনো লাভ নেই।’ তাঁর মতে, খারাপ জিনিস মানুষ সবচেয়ে বেশি দেখে। আর গান দেখা এক জিনিস, শোনা আরেক জিনিস এবং মনে রাখা আরেক জিনিস। তিনি বলেন, ‘গান হলো কানের শান্তি, মনের শান্তি। দেখবেন, অন্ধ লোকেও গান গায়, গান শোনে। একজন অন্ধ লোক যখন ট্রেনে চড়ে “হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ” গানটি গেয়ে ভিক্ষা করে, সেটা তো মনে গেঁথে যাওয়ার কারণেই। গানের ভিউটাকে সামনে না এনে গানটাকে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত। এ ধরনের প্রচারণা থেকে সবাইকে নিরুৎসাহিত করা উচিত।’

রুনা লায়লা

রুনা লায়লাবাংলাদেশের গানের শুভেচ্ছাদূতদের একজন রুনা লায়লা। একজীবনে ১০ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন, কিন্তু ভিউ বিষয়টি কী তিনি জানেন না বলে জানালেন। তিনি বলেন, ‘ভিউ কী? কীভাবে হয়? আসলেই হয়, নাকি করানো যায়—তা-ও জানি না। আমি এসব ব্যাপারে একটু পিছিয়ে আছি। আধুনিক যুগে হয়তো তাল মেলাতে পারছি না।’

রুনা লায়লা বলেন, ‘একটা বিষয় আমি বলব, ভিউ কম হোক আর বেশি হোক, কিছু গান যেগুলো রয়েছে, আমাদের সমসাময়িক ও জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের গান—নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা গাইছে। এটাই তো অনেক বড় ব্যাপার। এই গানগুলো এখনো মানুষ শুনছে তো। আমাদের সেসব গানের ভিউ ইউটিউবে হয়তো কম, কিন্তু মানুষের কানে বাজছে, হৃদয়ে গেঁথে আছে। যত দিন সংগীতজগৎ থাকবে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে যাবে ঠিকই, কিন্তু গানগুলো কখনোই মন থেকে মুছে যাবে বলে মনে হয় না। ইউটিউবে কতটা ভিউ হলো, এটা আমি দেখি না। আজকাল তো এমনও দেখি, গানের ভিডিও বানাতে গিয়ে গানটাই ‘সাইড লাইন’ হয়ে গেছে। ভিউ বাড়ানোর জন্য অনেকে ভিডিওতে স্ট্যান্টবাজিও করে। পারফরম্যান্সের কারণে গানটা যদি মার খেয়ে যায়, তাহলে তো আর কিছু থাকছে না। আমার মতে, গানটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

আলম খানআলম খানসংগীত ব্যক্তিত্ব আলম খান ১৯৬৩ সালে রবিন ঘোষের সহকারী হিসেবে চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। উপহার দিয়েছেন বহু কালজয়ী গান। তিনিও ভিউর ঘোর বিরোধী। বরাবরই তিনি গানের অডিওকে প্রাধান্য দিয়ে আসছেন।
আলম খান বলেন, ‘মানুষ সব সময় তো গান শোনে। গানটা আগে সুন্দর হতে হবে। ভিউ কখনোই মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না, যা এখন সবাই সামনে নিয়ে আসছে।’

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের গানের জগতে আলোচিত একটি গান ‘অপরাধী’। আরমান আলিফ নামের তরুণ একজন গায়ক এই গানটি গেয়েছেন। মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে এই গানের ইউটিউব ভিউ হয়েছে ১০ কোটি ৫৯ লাখ ৫৯ হাজারের বেশিবার। গানটি শুনেছেন আলম খান। তিনি বলেন, ‘গানটি আমি শুনেছি, এর ভিডিও দেখেছি। সহজ কথা ও সাধারণ সুরের গান। গানের কথার মধ্যে এখনকার তরুণেরা রিলেট করতে পেরেছে। শুনলাম, ১০ কোটি বারের বেশি শোনা হয়ে গেছে গানটি! কিন্তু এটা এত বেশিবার শোনার মতো গান না। কীভাবে যেন হয়ে গেছে। আমার আরেকটা বিষয় মনে হয়েছে, সাকিব আল হাসান ও তাঁর দলবল গানটা গেয়ে আরও বিখ্যাত করে দিয়েছে। সবাই যেখানে ভিডিওর জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করছে, আরমান সেখানে সাদামাটা একটা ভিডিও বানিয়ে গানটি প্রকাশ করেছে। গানের ক্ষেত্রে অডিওই যে প্রধান, তরুণ আরমান তা প্রমাণ করেছে। সে নিজেকে আরও ভালোভাবে গড়ে তুলুক, ভবিষ্যতে যেন সুন্দর হয়।’

ধ্রুব গুহধ্রুব গুহগানের জগতে দেড় বছরের পথচলা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ধ্রুব মিউজিক স্টেশনের। অল্প সময়ের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠান ৫৫ জন শিল্পীর শতাধিক গান প্রকাশ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি গানের ভিউও লাখ-কোটির ঘর স্পর্শ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ধ্রুব গুহ নিজেও গান করেন। তিনি বলেন, ‘কোনো গানের ভিউ অনেক বেশি মানে এটা শিল্পীর যোগ্যতার প্রধান মানদণ্ড, কিংবা গানটা অনেক ভালো, এটা ভাববার কোনো কারণ নেই। কিন্তু যদি দেখা যায়, যথেষ্ট ভিউ হয়েছে, মন্তব্যও ইতিবাচক, লাইক বেশি—তখন ভিউ বিষয়টাকে ইতিবাচকভাবে ধরা যেতে পারে।’

আবার অন্যদিকে কোনো গানের ভিউ বেশি, আবার সেই গানগুলো সমালোচিত হচ্ছে বলেও জানালেন ধ্রুব গুহ। তিনি বলেন, ‘একটা গান কতটা ভালো হয়েছে, শিল্পী কতটা ভালো গেয়েছেন—সেটা ইউটিউবের মন্তব্যের ঘরে ঢুঁ মারলেও বোঝা যায়। আমরা এ-ও দেখি, কিছু কিছু গানের ভিউ হয়েছে অনেক কিন্তু সমালোচিতও হয়েছে। লাইকের তুলনায় ডিজলাইক বেড়েছে, তেমন গান আমার ইউটিউব প্ল্যাটফর্মেও আছে। তার মানে শ্রোতারা শুনছেন ঠিকই, কিন্তু গানগুলো সেভাবে গ্রহণ করেননি। সুতরাং ভিউ অনেক বেশি, এই ভেবে ইতিবাচক তৃপ্তি পাওয়া যাবে না।’

এক দিনে পাঁচ লাখ, তিন দিনে দশ লাখ ভিউ—এমন কথা ইদানীং প্রায়ই শোনা যায়। এটাকে প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই না—বলছেন ধ্রুব গুহ। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি দেখেন কোনো শিল্পীর একটা গান অনেক দিন ধরে ইউটিউব প্ল্যাটফর্মে আছে। তা দিনকে দিন অন্তত ২০ হাজার কিংবা ৩০ হাজার করে ভিউ বাড়ছে এবং মন্তব্য ইতিবাচক, লাইকের সংখ্যা বাড়ছে—সেটাকে ইতিবাচক ধরতে হবে।’

ডিজিটাল এই যুগে সার্চিং তালিকায় একজন শিল্পীর নাম আছে কি না, সেটাকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন তিনি। বলেন, ‘অনলাইনের সার্চিং তালিকায় থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাম কিংবা মফস্বলের একজন শ্রোতা মোবাইলে কী সার্চ করছে, ব্যবসায়ী হিসেবে এটা আমার ভাবনায় থাকে। শ্রোতার সার্চিং লিস্টে একজন শিল্পী যত দিন না আসবেন, তত দিন কাজ করে যেতে হবে। ভিউ প্রধান মানদণ্ড হওয়া উচিত নয়। এটা দিয়ে কখনোই একজন ভালো শিল্পীর মানদণ্ড মাপা যায় না।’

source

Comments

Popular posts from this blog

‘জাহাজ ভাঙা শিল্পের উন্নয়নে নরওয়ে দিয়েছে ১২ কোটি টাকা’

The stars are back on the red carpet

Instant breakfast with quick hands